প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাঁধা, সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা হেনস্তা, মধ্যরাতে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক্্র মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এখন রীতিরকম সরগরম। চায়ের দোকান থেকে মিডিয়ার টকশো পর্যন্ত চলছে এ আবেগ-উত্তাপ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় গণমাধ্যমকে। দেশের প্রতিটি সরকারই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবতা নির্মম। প্রায় প্রতিদিনই কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীরা। প্রতিটি সরকারের সময়ে, সব ধরনের পরিস্থিতিতে। কখনও শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, কখনও শিকার হচ্ছে হয়রানির। কখনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে, কখনও রাষ্ট্রের হাতে। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নেমে আসে খড়গ। হামলা, মামলা, আর হয়রানিতে দুর্বিষহ করে তোলা হয় জীবন।
গণমাধ্যমের এ আক্রান্ত দেশের গণতন্ত্র যে রুগ্নতম সময় পার করছে তা অনুমেয়। কেননা, গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র অবস্থানের দিক থেকে একই সুতোয় গাঁথা। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করলেও পুলিশি নির্যাতনেরও শিকার হতে হয় সংবাদকর্মীদের। যদিও উভয়ই ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে। কিন্তু রাজপথে, বিপজ্জনক মুহূর্তে মাঝেমধ্যে পুলিশই হয়ে পড়ে সাংবাদিকের প্রতিপক্ষ। পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতির ঝাল মেটান সাংবাদিকদের ওপর। পরে ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর মতো মৌখিক দুঃখ প্রকাশও করেন। এটুকুতেই প্রতিকারের সমাপ্তি। একইভাবে রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকের সম্পর্ককে আখ্যায়িত করা হয়- জল ও মাছের সম্পর্কে। কিন্তু যতই বস্তুনিষ্ঠ হোক, নিজের বা নিজ গ্রুপের বিপক্ষে গেলেই প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েন রাজনীতিবিদরাও। তারাও হুমকি-ধমকি দেন, কর্মক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে সাংবাদিকদের ‘উপহার’ দেন বেকারত্ব। নিজস্ব সুবিধাবাদীদের দিয়ে মামলায় জড়িয়ে দেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। আমলারা করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা হয়রানি। সাংবাদিকতার নৈতিকতায় সাংবাদিকরা কারো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হতে পারে না। অনিয়মের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতেই হয়। ফলে সাংবাদিকরা হয়ে পড়ে অপছন্দের পাত্র। তাদের গলা টিপে ধরতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে সবাই। অথচ অপছন্দের কথাগুলো তুলে ধরতে হয় দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের সময়েই সাংবাদিকদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ। রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংবাদিকরা নির্যাতিত হচ্ছেন তাই নয়, স্বার্থান্ধ রাজনীতিবিদদের ক্যাডার ও সন্ত্রাসী চরমপন্থিদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত, এমনকি খুন হচ্ছেন সাংবাদিকরা।
অথচ শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিটি সরকারই থাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কোনো সরকারের হাতেই প্রনীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। এমনকি দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচার প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিরও। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিনের পর দিন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তেমন কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিন সংবাদ পিপাসু মানুষের দ্বারে নতুন নতুন খবর নিয়ে হাজির হয় সাংবাদিকরা। তাঁদের লেখনি বা সংবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে সকালে চায়ের কাপে ঝড় থেকে শুরু করে মানুষ সুফল পেতে শুরু করে। নির্যাতিত মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে সাংবাদিকদের দারস্থ হয়। আর সাংবাদিকরা জাতির সামনে তুলে ধরে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সুখ, দুঃখ,হাসি কন্না,সাফল্য ব্যার্থতার কথা। কিন্তু সেই সাংবাদিক যখন নির্যাতিত হয় তখন সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজও আমাদের রাজপথে দাঁড়িয়ে এই পৈশাচিক ঘটনার বিচার দাবি করতে হচ্ছে। এসব হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিচার না হলে সাহসী সাংবাদিক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে না আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার। সরকার, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন রাখছি, সুষ্ঠু বিচার, প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থা গ্রহণের। সাংবাদিকদের পেশায় এ চলমান ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্র কি কোনো উদ্যোগ নেবে? দূর ভবিষ্যতে কি কোনো উজ্জ্বল আলো অপেক্ষা করছে? সেই উত্তরের প্রতীক্ষায়–।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, ‘সংবাদপত্র বিষয়ক আইন’ গ্রন্থ’র’ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮